জৈব কৃষি মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে

মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে সমৃদ্ধ করা

জৈব কৃষি

মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে সমৃদ্ধ করতে হলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ, ফসলের অবশিষ্টাংশ ক্ষেতে আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার, জৈব ও জীবাণুসার ব্যবহার, ফসলের পর্যায়ক্রমিক চাষ, একাধিক ফসল চাষ, মাটির উপর সর্বদা সবুজ আচ্ছাদন বজায় রাখা, অত্যধিক কর্ষণ বন্ধ করা প্রভৃতি প্রয়োজন।

জৈব সারের উল্লেখযোগ্য উপকারী বৈশিষ্ট্যগুলি হল

(ক) খাদ্যপ্রাণ গুলি ধীরে ধীরে মুক্ত হয় ও গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসে। ফলে, এই সার দীর্ঘদিন ধরে কার্যকরী থাকে,

(খ) মাটির ভৌত ধর্মের মান যেমন, গঠন, গ্রখন, জলধারণ ও বায়ুচলাচল ক্ষমতা ইত্যাদির উন্নতি ঘটায়,

(গ) মাটির প্রাণ ‘হিউমাস’ গঠন করে,

(ঘ) মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুগুলির বংশবৃদ্ধি করে,

(ঙ) জৈবসার হল প্রকৃতিগতভাবে সুষম সার এবং এতে প্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যগুণই অল্প বিস্তর বর্তমান থাকে,

(চ) কচুরীপানা, ধানের খড়, তুষ ইত্যাদি জৈব আচ্ছাদনের কাজ করে।

জৈব সারের বৈচিত্রও কম নয়। গোবর সার, খোল, কেঁচো সার, পোলট্রি সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, হাড় গুঁড়ো, শিং গুঁড়ো প্রভৃতির প্রয়োগ যথেষ্ট কার্যকরী ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

জৈব বস্তুর পুনরাবর্তন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন, ঘরোয়া অথচ অর্থবহ প্রযুক্তি। গবাদি পশুর মলমূত্র, ফসলের ফেলে দেওয়া বা অপ্রয়োজনীয় অবশেষ (crop residues), সবুজ লতা-পাতা, আগাছা ইত্যাদি খামারের সার বা কেঁচো সার রূপে ক্ষেতে প্রয়োগ করার প্রচলিত পদ্ধতিকে বিস্মৃত না হয়ে আরও পরিশীলিত, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করে প্রয়োগ করতে হবে।

জীবাণু সারের ব্যবহার জৈব কৃষি ক্ষেত্রে যুগান্ত সৃষ্টি করার শক্তি ধরে। উপযুক্ত পরিকাঠামো, উৎপাদন, উন্নত মানের জীবাণুসারের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে তেমনভাবে প্রসার লাভ না করলেও জীবাণুসারের উপকারিতা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। শুধুমাত্র প্রয়োজন কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি, সহজলভ্যতা আর উপযুক্ত গুণমানের সরবরাহ। তাহলেই কম খরচে, কম মেহনতে রাসায়নিক সারের একটা ভালো বিকল্প পাওয়া যাবে জীবাণুসারের মধ্য দিয়ে।

সময়মতো নীল সবুজ শ্যাওলা ও অ্যাজোলা চাষ করে জমির মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ভালো পরিমাণ উদ্ভিদ পুষ্টির সাথে সাথে জৈবসার যোগ করা যায়। তরল সার প্রয়োগ জৈব কৃষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সার সহজে গাছ গ্রহণ করতে পারে, উদ্ভিদ খাদ্য খুবই সহজলভ্য অবস্থায় পাওয়া যায়। তরলসারের সঙ্গে ফসলের অবশিষ্টাংশও মেশানো হয়। প্রতিটি ফসলে একর প্রতি ২০০ লিটার করে তরল সার ৩-৪ বার করে সেচ বা বৃষ্টির পরে পরে প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া, গরুর মূত্র ও ভার্মি ওয়াশ প্রতিটি ফসলে ২-৩ বার স্প্রে করা হয়। পরীক্ষিত এবং সুপারিশকৃত কয়েকটি তরল সার হল—

সঞ্জীবক : ২০ কেজি গোবর, ১০ লিটার গোমূত্র, ৫০০ গ্রাম ঝোলা গুড়, ৩০ লিটার জলে গুলে আবদ্ধ ড্রামে ১০ দিন পঁচানো হয়। তারপর ওই মিশ্রণ জল মিশিয়ে ২০ গুণ বৃদ্ধি করে মাটিতে বা সেচের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয় এক একর জায়গাতে।

জীবাত: ১০ কেজি গোবর, ১০ লিটার গোমূত্র, ২ কেজি ঝোলা গুড়, ২ কেজি গমের ময়দা ও ২ কেজি জীবন্ত-বস্তু যুক্ত মাটি ২০০ লিটার জলে গুলে ৫-৭ দিন পচানো হয়। পচানোর সময় প্রত্যহ ৩ বার দ্রবণটিকে নাড়ানো হয়। ঐ মিশ্রণ সেচের জলের সঙ্গে মিশিয়ে এক একরে প্রয়োগ করা হয়। একটি ফসলে মোট ৩ বার প্রয়োগ করা উচিৎ। প্রথমবার বীজ বোনার আগে, দ্বিতীয় বার বীজ বোনার ২০ দিন পর এবং তৃতীয় তথা শেষ বার ৪৫ দিন পর।

পঞ্চগব্য: ৪ কেজি গোবর গোলা, ১ কেজি টাটকা গোবর, ৩ লিটার গো-মূত্র, ২ লিটার গোরুর দুধ, ২ লিটার দই, ১ কেজি মাখন অয়েল মিশিয়ে ৭ দিন আবদ্ধ পাত্রে পচানো হয়। প্রত্যহ ২ বার করে নাড়ানো হয়। ২০ লিটার পঞ্চগব্য জলে গুলে ৬৫০ লিটার মিশ্রণ ১ একরে স্প্রে করা হয়। বীজ শোধনের কাজেও এটি ব্যবহার করা যায়।

সমৃদ্ধ পঞ্চগব্য : ১ কেজি টাটকা গোবর, ৩ লিটার গোমূত্র, ২ লিটার গোরুর দুধ, ২ লিটার দই, কেজি দেশি ঘৃত, ৩ লিটার আখের রস, ৩ লিটার নারকেলের জল, ১২টি কলা একসঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে আবদ্ধ পাত্রে ৭দিন পচানো হয়। ২০ লিটার এই মিশ্রণ ৬৫০ লিটার জলে গুলে ১ একর জমির মাটির ওপরে স্প্রে করে সেচ দেওয়া হয়।

মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে সমৃদ্ধ করে জৈব কৃষির উপযোগী করার কয়েকটি পদ্ধতিঃ

কম খরচের উপকরণ ব্যবহার : প্রথম বছর পর পর তিনটি ডালজাতীয় ফসল বিভিন্ন জমিতে লাগানো হয়। প্রথমটি ৬০ দিনের দ্বিতীয়টি ৯০-১২০ দিনের এবং তৃতীয়টি ১২০ দিনের বেশি মেয়াদি হওয়া দরকার। ফসল হিসাবে কেবলমাত্র শুটিগুলি তুলে নেওয়া হয়।

ফসলের অবশিষ্টাংশ ও উপড়ানো আগাছা ফসল ক্ষেতে মাটির আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় বছরে একর প্রতি ২০ কুইন্টাল জৈবসার প্রয়োগ করে একটি তন্ডুল শস্য ও একটি ডাল শস্য পাশাপাশি বা সাথী ফসল হিসাবে চাষ করা হয়। ফসল তোলার পরে ধানের শীর্ষ ও ডালশস্যের শুটি সংগ্রহ করে বাকি অংশ মাটির আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে এরপর একটি গ্রীষ্মকালীন ডালশস্য কিছু সবজির সঙ্গে করা যাবে। ফসলের অবশিষ্টাংশ সর্বদা আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ফসলে ৩-৪ বার তরল সার মাটিতে প্রয়োগ করা হয়।

বেশি খরচের উপকরণ ব্যবহার : একর প্রতি ১০ কুইন্টাল কম্পোস্ট / কেঁচোসার, ২০০ কেজি খোল, ২০০ কেজি রক ফসফেট, ৪০ কেজি নিম খোল, ৬ কেজি পি এস বি জীবাণুসার মাটির সঙ্গে মেশানো হয়। তারপর ৩-৪ রকমের ফসল ফালিতে লাগানো হয়। ৪০ শতাংশ ফসল হবে শিষ জাতীয় / ডাল জাতীয় ফসল তোলার পর দানা ও বীজ সংগ্রহ করে বাকী অংশ পরবর্তী ফসলের জমিতে আচ্ছাদন হিসাবে কাজে লাগানো হয়। প্রথমবারের মতো একই পরিমাণ সার প্রয়োগ করে দ্বিতীয় ফসল লাগানো হয়। প্রতিটি ফসলে ৩-৪ বার ২০০ লিটার করে তরল সার প্রয়োগ করা হয়।

১২-১৮ মাসের মধ্যে মাটি যেকোন ফসল চাষের উপযোগী হয়ে যায়। পরবর্তী ২-৩ বছর সব সময় ডালশস্যকে সাথী ফসল হিসাবে লাগানো হয়। মাটির আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহৃত ফসলের অবশিষ্টাংশের ৩০ শতাংশ ডালজাতীয় ফসলের অবশিষ্টাংশ হওয়া উচিৎ। ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটির মধ্যে প্রয়োগ বা আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহারের আগে তরল সারের সঙ্গে মাখানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *