ধান চাষ

ধান

ধান পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ফসল। ধানের দানাশস্য উৎপাদন ও বীজ উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে মোটামুটি সাদৃশ্য থাকলেও তা পুরোপুরি এক নয়। বীজ উৎপাদনের জন্য বিশেষ কিছু সর্তকতা অবলম্বন করতে হয় তার গুণমান সঠিক রাখার জন্য। বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে পরিমাণ বৃদ্ধির চেয়ে গুণমান বৃদ্ধির দিকে বেশী নজর রাখা উচিত।

‘খাদ্যের আধারে সুরক্ষিত জীবন্ত ও ঘুমন্ত ভ্রূণই হচ্ছে বীজ’। ধান উৎপাদনে আমরা বেশী উৎসাহী ফলন বৃদ্ধিতে। সেক্ষেত্রে দানার পুষ্টতা ও সংখ্যা বৃদ্ধিই একমাত্র লক্ষ্য। বীজের ক্ষেত্রে দানার পুষ্টতা ও সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও তার বাহ্যিক চেহারা—১) চারিত্রিক শুদ্ধতা, ২) আর্দ্রতা, ৩) রোগ-পোকার উপস্থিতি, ৪) অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা, ৫) সুপ্ত দশা, ৬) জীবনী শক্তি প্রভৃতি বিষয়গুলির উপর বিশেষ নজর রেখে উৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতিকে পরিচালিত করতে হয়।

আমরা চাষের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি একই জাতের বীজ বছরের পর বছর চাষ করলে তার বৈশিষ্ট্য ও ফলন ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। এই অবনমনের গতি দেশী জাতগুলির ক্ষেত্রে কম কিন্তু কৃত্রিমভাবে তৈরী উচ্চফলনশীল গুলির ক্ষেত্রে এই গতি অনেক বেশী।

জাতের বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য অন্যতম কারণগুলি হ’ল কৃষি জলবায়ুর প্রভাব, যান্ত্রিক মিশ্রণ, সূর্যের রশ্মির প্রভাবে জিনের পরিবর্তন, মাঠে অন্য জাতের সাথে স্বাভাবিক অবাঞ্ছিত পরাগ মিলন ও ভ্রান্ত কৃষি পরিচর্যার প্রভাব।

এই বিষয়গুলি মাথায় রেখে ধানের বীজ উৎপাদনের জন্য নিম্নলিখিত পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপগুলির উপর বিশেষ নজর দিতে হবে

১) জলবায়ু ও কৃষিক্ষেত্র নির্বাচন

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি জলবায়ু ধান ও ভালো মানের ধান বীজ উৎপাদনের পক্ষে উপযোগী। আমাদের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূমের বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম থাকায় ধানের বীজে রোগের আক্রমণ অনেক কম হয় বলে সেখানের রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী জাতের অত্যন্ত উৎকৃষ্টমানের ধান বীজ তৈরী করা যায়।

খানের জাতের মেয়াদ অনুযায়ী জমি নির্বাচন করা প্রয়োজন। সাধারণতঃ সমস্যাযুক্ত জমিগুলি অর্থাৎ যেখানে যাতায়াতের সমস্যা রয়েছে, বা গাছের ছায়া এসে পড়ে, বা নিকাশীর

উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই বা প্রয়োজনে সেচ দেওয়া যাবে না বা নোনার সমস্যা রয়েছে বা একান্তই অনুর্বর ধরণের জমিতে ধান চাষ করা গেলেও বীজ তৈরীর জন্য নির্বাচন না করাই ভালো।

বিশেষভাবে তৈরী ধানের জাতগুলি যেমন, খরা সহনশীল জাত বা নোনা সহনশীল জাতগুলির বীজ খরাপ্রবণ বা নোনা প্রবণ এলাকাতেই তৈরী করা উচিত। অন্যথায় বছরের পর বছর যদি অন্যত্র তৈরী করা হয় তবে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অবনমন ঘটে।

3) জাত নির্বাচন—

জমির অবস্থান অনুযায়ী জাত নির্বাচন করতে হবে। সাধারণতঃ যে জাতগুলি যে অঞ্চলে ভালো হয় সেই জাতগুলিকেই ঐ অঞ্চলে বীজ উৎপাদনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। পাশাপাশি নতুন জাতগুলি নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে।

৩) ফাউণ্ডেশন / সার্টিফায়েড বীজ সংগ্রহ

নিজের প্রয়োজনীয় বীজ নিজে তৈরী করতে হলে প্রাথমিক বীজটা ভালো হওয়া অত্যন্ত জরুরী। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক বীজ হিসেবে সরকারী কৃষি খামার বা অন্যান্য বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ধানের উপযুক্ত জাতটির ফাউণ্ডেশন বা সার্টিফায়েড বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ কেনার আগে প্যাকেটের গায়ে ফাউন্ডেশন বা সার্টিফায়েড এর উপযুক্ত কার্ড লাগানো আছে কিনা, ব্যাগটি ঠিকমতো সীল করা আছে কিনা, তার কার্যকরী মেয়াদ ইত্যাদি বিষয়গুলি উল্লেখ আছে কি না তা দেখে, ক্রেতা ও বিক্রেতার সই সহ ক্যাশ মেমো সহ বীজ সংগ্রহ করতে হবে।

৪) বীজ শোধন—

প্রাথমিকভাবে বীজ ব্যবহারের পূর্বে রোদে কয়েক ঘন্টা ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে একটু হাত বাছাই করে অবাঞ্ছিত বীজ বা মিশে থাকা অন্যান্য বস্তু বাদ দিয়ে দিতে হবে। যদি শুকনো বীজতলা বা ‘কাকড়ি’ বীজতলা করা হয় তবে প্রতি কেজি বীজের সাথে ২ ৩ গ্রাম কার্বেণ্ডাজিম বা থাইরাম জাতীয় ওষুধ মিশিয়ে নিতে হবে। যদি কাদানো বা ‘পেকে’ বীজতলা করা হয় তবে বীজ ভেজানোর পুরো সময়ের শেষ আট ঘন্টা ওষুধ মেশানো জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি বীজের জন্য দেড় লিটার জল ও তিন গ্রাম ঐ ওষুধগুলি লাগবে। তারপর ওষুধ মেশানো জল থেকে বীজ তুলে অতিরিক্ত জল ঝরিয়ে নিয়ে, কলাপাতা বা চটের বস্তার উপর পাতলা ভাবে মেলে দিয়ে ভিজে চট, খড় ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে জাঁক দিতে হবে। ভেতরের তাপমাত্রা যেন কখনই ৩০“ সেন্টিগ্রেডের বেশী না হয়। অর্থাৎ হাত ঢুকিয়ে দেখে নিতে হবে যেন গরম না লাগে। সেরকম হলে ঢাকা খুলে বীজ নেড়ে চেড়ে নিয়ে হালকা করে জল ছিটিয়ে আবার ঢেকে দিতে হবে। এইভাবে দুই-তিনদিনের মধ্যে বীজে ‘কল’ বেরিয়ে যাবে। আমাদের রাজ্যে অনেকে পুকুরে বীজের বস্তা এক বা দু-রাত ভিজিয়ে রেখে পরে খড়ের গাদায় বীজসহ বস্তা ঢুকিয়ে রেখে বীজ কলা করে নেন। পদ্ধতিটি সঠিক নয়। এতে বস্তার মাঝখানের বীজগুলি অক্সিজেনের অভাবে ও অতিরিক্ত তাপমাত্রায় সঠিকভাবে অঙ্কুরিত হয় না। ভ্রূণটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

ক্লিক করে আরও পড়ুন

৫) বীজতলা তৈরী

Leave a Comment