ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্রের নাম: হরপ্পা-সংস্কৃতির বা সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কারা ?

উত্তর। ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্র সিন্ধু প্রদেশের মহেঞ্জোদারো এবং পাঞ্জাবের হরপ্পা।

আর্যজাতি

হরপ্পা-সংস্কৃতির বা সিন্ধু-সভ্যতার স্রষ্টা কারা ছিলেন এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, বৈদিক আর্যজাতি হরপ্পার স্রষ্টা। কিন্তু ব্যাসাম-সহ বহু পণ্ডিত যুক্তি দ্বারা এই মত খণ্ডন করেছেন। এঁদের মতে, আর্যরা যদি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা হয়ে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, খ্রীষ্টের জন্মের তিন হাজার বছর পূর্বে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু ইতিহাসগতভাবে এই কথা কখনই মানা যায় না। তাছাড়া আর্যসভ্যতা ছিল মূলত গ্রামীণ। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতা

সুমেরীয়

 অপর একদল পণ্ডিত সুমেরীয়দের ‘হরপ্পার স্রষ্টা’ বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু মার্শাল, ব্যাসাম প্রমুখ ঐতিহাসিকরা উভয় সভ্যতার মধ্যে একাধিক প্রভেদ ও স্বাতন্ত্র্য উল্লেখ করে এই মতেরও বিরোধিতা করেছেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, দ্রাবিড়জাতি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা। এঁরা যুক্তি হিসেবে বলেছেন যে, প্রাগ্-আর্য যুগে দ্রাবিড়জাতি সমগ্র ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।

ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতেও তাদের বিস্তৃতি ছিল ধরা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দক্ষিণ-ভারতীয়দের মধ্যে মোঙ্গলীয় ও আলপীয় জাতির মিশ্রণ দেখা

দ্রাবিড়

অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, দ্রাবিড়জাতি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা। এঁরা যুক্তি হিসেবে বলেছেন যে, প্রাগ্-আর্য যুগে দ্রাবিড়জাতি সমগ্র ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতেও তাদের বিস্তৃতি ছিল ধরা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দক্ষিণ-ভারতীয়দের মধ্যে মোঙ্গলীয় ও আলপীয় জাতির মিশ্রণ দেখা  যায়। হরপ্পা-সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ থেকেও এইরূপ শারীরিক গঠনসম্পন্ন মানুষের প্রাধান্য প্রমাণিত হয়েছে। ঐতিহাসিক ফিলিওজা বলেছেন যে, “আর্য-পূর্ব ভারতীয় জনগণের মধ্যে দ্রাবিড় ও মুণ্ডাই ছিল প্রধান।” মুণ্ডারা ছিল অসংস্কৃত, কিন্তু দ্রাবিড়গণ ছিল উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। এদিকে হরপ্পা-সংস্কৃতিও ছিল উন্নত। তাই এর স্রষ্টা হিসেবে দ্রাবিড়দের সনাক্ত করলে অযৌক্তিক হবে না। ধর্মগত বিষয়েও এই দুই সভ্যতার মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। শিব-শক্তি ও লিঙ্গ পূজা উভয় সংস্কৃতিরই অঙ্গ ছিল। বিখ্যাত লিপি-বিশারদ ফাদার হেরাস-এর মতে, “হরপ্পা-লিপি প্রাচীন তামিলদের আদি রূপ।”

বিরুদ্ধ মত

অবশ্য এই মতের বিরুদ্ধেও যুক্তির অভাব নেই। যেমন উভয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-পদ্ধতি এক নয়। দ্রাবিড়জাতির মধ্যে মৃতদেহ সমাহিত করার রীতি প্রচলিত ছিল; কিন্তু সিন্ধু-উপত্যকা খনন করে শবদাহ’ -রীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া, দ্রাবিড়জাতি দক্ষিণ-ভারতে একটি সভ্যতার ধারক ও বাহক ছিল। তাই তারা যদি হরপ্পা-সংস্কৃতিরও স্রষ্টা হত, তাহলে সিন্ধু-উপত্যকা অঞ্চলে প্রাপ্ত নিদর্শনের অনুরূপ নিদর্শন কিছু-না-কিছু দক্ষিণ-ভারতে পাওয়া যেত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু আবিষ্কৃত হয়নি।

মিশ্র-সভ্যতা

উপরিলিখিত আলোচনা থেকে বলা যায়, হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা কারা, এ সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য কোন সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। উক্ত অঞ্চলে ককেশীয়, ভূমধ্যসাগরীয়, আল্পীয় ও মোঙ্গলীয় এই চার প্রকারের লোকের অবস্থান ছিল। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, বিভিন্ন জাতির লোকের সংমিশ্রণে হরপ্পা-সংস্কৃতির সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছিল। দ্রাবিড়রাও সম্ভবত এই বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *