বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও লেখকদের দৃষ্টিকোণ থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি | পরিলক্ষিত হয়—
1] গণমুখী আন্দোলন
সাঁওতাল বিদ্রোহ কেবলমাত্র সাঁওতালদের বিদ্রোহ ছিল না; কুমোর, কামার, গোয়ালা, ডোম, তেলি, চামার প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এই আন্দোলনকে গণমুখী করে তুলেছিল।
2] শোষিত মানুষের বিদ্রোহ
সাঁওতাল বিদ্রোহের চরিত্র | ব্রিটিশ-বিরোধী হলেও বিদ্রোহীরা জমিদার, মহাজনদের ওপর আঘাত হেনেছিল।
3] সকলের বিদ্রোহ
সাঁওতাল বিদ্রোহে নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতি, বয়স্ক পুরুষ-মহিলা অর্থাৎ বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষেরা অংশগ্রহণ করেছিল।
4] ব্রিটিশ বিরোধিতা
বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে বলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান। রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে যদি স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া হয় তাহলে সাঁওতাল বিদ্রোহের একই মর্যাদা পাওয়া উচিত।
উপসংহার
ঐতিহাসিক কালীকিঙ্কর দত্তের মতে, বিদ্রোহ ক্রমশ নিম্নশ্রেণির গণবিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল। গবেষক সাঁওতাল সুপ্রকাশ রায় সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরুপ বলে অভিহিত করেছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর) ভূমিকা : ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল বা গুরুত্বকে কখনোই ছোটো করে দেখা হয় না। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব হল—
1) সাঁওতাল পরগনা গঠন
সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান হলে সাঁওতালদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড গঠনে প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে ব্রিটিশ সরকার একপ্রকার বাধ্য হয়েই সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামক পৃথক একটি এলাকা গঠন করে।
2) পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি
সরকার সাঁওতালদের একটি পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং সাঁওতাল পরগনায় সরকারি কোনো আইন কার্যকরী হবে না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
3) জমিদারি ও মহাজনি শোষণ হ্রাস
সাঁওতাল পরগনায় তিন বছরের জন্য মহাজন ও জমিদারদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে জমিদার ও মহাজনদের শোষণের হাত থেকে সাঁওতালরা সাময়িক কালের জন্য নিষ্কৃতি পায়।
৪) ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পথপ্রদর্শক
সাঁওতাল বিদ্রোহীরা তিরধনুক, টাঙ্গি, তরবারি সম্বল করে সুশিক্ষিত সরকারি বাহিনীর বন্দুকের সামনে যে বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে তা পরবর্তী কৃষক বিদ্রোহ তথা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথনির্দেশ করেছিল।
5) কর হ্রাস
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলেই সাঁওতালদের জমির ওপর কর হ্রাস করা হয়। সাঁওতাল পরগনাকে যতদূর সম্ভব ভারতীয় জনস্রোতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।
উপসংহার
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে শুধুমাত্র সাঁওতালদের মধ্যেই নয়, সামগ্রিকভাবে নিম্নশ্রেণির কৃষকদের মধ্যে স্বাধীনতার যে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়, তা মহাবিদ্রোহের মাধ্যমে দাবানলে পরিণত হয়।
মুন্ডা বিদ্রোহের (১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) কারণগুলি আলোচনা করো।
উত্তর ভূমিকা
বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে রাঁচিসহ ছোটোনাগপুর অঞ্চলে মুন্ডা উপজাতির মানুষদের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ ও অসন্তোষের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ছিল মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ)।
মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ : সহজ, সরল কৃষিজীবী মুন্ডাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিদ্রোহের কারণগুলি হল—
1) জমির ওপর অধিকার হারানো
ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে বাইরের থেকে লোভী মানুষেরা এসে নিরীহ কৃষিজীবী মুন্ডাদের জমি জায়গা কুক্ষিগত করে নিতে থাকে এবং মুন্ডাদের বিতাড়িত করে সেই জমিগুলি দখল করে নিলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।
2) ‘খুঁৎকাঠি প্রথা’র অবসান
ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর মুন্ডাদের ‘খুঁৎকাঠি প্রথা’ বা জমির যৌথ মালিকানার অবসান ঘটিয়ে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা (মাঝিহাম) প্রতিষ্ঠিত হলে মুন্ডারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
3) নতুন আইনবিধি
ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর মুন্ডাদের চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী ‘মুন্ডারি আইন’, বিচার ও সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নতুন ধরনের আইন প্রবর্তন করলে মুন্ডারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
4 বেগার শ্রম
নিরীহ মুন্ডাদের দিয়ে সরকারি কর্মচারী, জমিদার, মহাজনরা দিনের পর দিন বিনা মজুরিতে ‘বেঠবেগারি’ প্রথায় কাজ করতে বাধ্য করলে অবশেষে মুন্ডারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।
5) বীরসা মুন্ডার ভূমিকা
ধর্মপ্রচারক হিসেবে জীবন শুরু করলেও বীরসা মুন্ডার সংস্কারমূলক বিবিধ ব্যবস্থা, হীনম্মন্যতাকে দূর করে মুন্ডাদের মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা ছিল মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
অন্যান্য কারণ
উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়াও মহাজন, জমিদার, জায়গিরদার, ঠিকাদার, চা ব্যবসায়ীদের মিথ্যা প্রলোভন ও শোষণ এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচার এই বিদ্রোহের ইন্ধন জোগায়।