ভূমিকা (Introduction) : ঐতিহাসিক স্মিথ (V. Smith) বলেছেন : “The root of Hinduism go down to the Vedic text.” সাধারণভাবে একথা মনে করা হত যে, আর্যদের আগমনকাল থেকে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। কিন্তু বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সিন্ধু-উপত্যকা অঞ্চলে এক প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে পূর্ববর্তী ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। সিন্ধুনদের ধারে করাচী থেকে ২০০ মাইল উত্তরে মহেঞ্জোদারো এবং আরও উত্তরে বর্তমান লাহোর থেকে প্রায় ১০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ইরাবতী নদীর ধারে হরপ্পায় এই প্রাচীনতম সভ্যতার সন্ধান আবিষ্কৃত হয়েছে।
মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা নগরীর মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৪০০ মাইল। এই সমগ্র অঞ্চলব্যাপী সভ্যতা, সভ্যতার বিচারে এটি দ্রাবিড় সভ্যতার অনুরূপ। অধুনা ঐতিহাসিকরা ‘হরপ্পা-সংস্কৃতি’ (Harappan Culture) নামে অভিহিত করার পক্ষপাতী।
তবে এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাথমিক ইতিহাস এখনো ধোঁয়াশায় ভরা। ঠিক কখন এই সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল সে প্রশ্ন এখনো মীমাংসার অপেক্ষায়। ঠিক তেমনি এই সুমহান সভ্যতার স্রষ্টা কারা, সে বিষয়ের শেষ কথা বলা সম্ভব হয়নি। এই সভ্যতার জনকরা বহিরাগত না-কি ভারতীয়? বহিরাগত হলে কোন্ দেশীয় এবং ভারতীয় হলে কোন্ জাতিভুক্ত?—এইরূপ নানা প্রশ্ন পণ্ডিতদের কাছে জটিলতা বৃদ্ধি করেছে।
প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ ও নিদর্শনাদি বিচার করে ঐতিহাসিকেরা এইসব প্রশ্নের উত্তর পাবার চেষ্টা করেছেন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বৈদিক সভ্যতার পূর্বেই হরপ্পা-সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে এবং তা বৈদিক-সভ্যতার থেকে অনেক বেশি উন্নত। ‘সিন্ধু-সভ্যতা’ বা ‘হরপ্পা-সংস্কৃতি’ নামে ইতিহাসে স্থান পেলেও, শুধুমাত্র সিন্ধু-উপত্যকা অঞ্চলে এই সভ্যতা সীমাবদ্ধ ছিল না।
আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। উত্তরে হিমালয়সংলগ্ন অঞ্চল, দক্ষিণে ক্যাম্বে উপসাগর এবং পশ্চিমে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই সভ্যতার রেশ দেখা যায়। পরবর্তীকালে ভারতের পূর্বাঞ্চলেও এর প্রসার ঘটেছিল।
তবে গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে এই সংস্কৃতির প্রভাব ছিল না বলেই অনুমিত হয়। প্রাচীনত্বের দিক থেকে এই সভ্যতা নদীকেন্দ্রিক মিশর-আসিরীয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সমসাময়িক ছিল বলে অনুমান করা হয়। ভারতের সুপ্রাচীন ও অতি উন্নত হরপ্পা-সংস্কৃতির সূচনাকাল যেমন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, এর অন্তিম লগ্নও তেমনি অস্পষ্ট। কেন বা কিভাবে এত উন্নত একটা সভ্যতার বিনাশ ঘটেছিল, তা এখনো পণ্ডিতদের কাছে একটা জিজ্ঞাসা-চিহ্ন রূপে দাঁড়িয়ে আছে।