ভূমিকা (Introduction) : প্রাচীন হিন্দুযুগে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলবিশেষে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। উত্তরবঙ্গে পুণ্ড্র ও বরেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গে রাঢ় ও তাম্রলিপ্তি এবং পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গে বঙ্গাল, হরিকেল, সমতট, বঙ্গ প্রভৃতি। মুসলমানদের আগমনের পরই এদেশ একত্রে ‘বাংলা‘ বা ‘বাঙ্গালা‘ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে সমগ্র বাংলাদেশ ‘গৌড়’ ও ‘বঙ্গ’ নামে সাধারণভাবে পরিচিত হয়েছে। উত্তরে হিমালয় পর্বত থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে গারো ও লুসাই পর্বত থেকে পশ্চিমে রাজমহল পর্যন্ত সমতলভূমি নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত। ছোট-বড় একাধিক নদ-নদী বাংলাকে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে।
বাংলাদেশের আদি অধিবাসীরা আর্যজাতির বংশোদ্ভূত নয় বলেই পণ্ডিতদের অনুমান। আর্যদের আগমনের পূর্বে বিভিন্ন অনার্য জাতি এই ভূখণ্ডে বসবাস করত। বৈদিক যুগের একেবারে শেষদিকে বাংলায় আর্য-সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ক্রমে আর্যদের ভাষা, ধর্ম ও বিভিন্ন সামাজিক রীতি-নীতি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গুপ্ত যুগের পূর্বে প্রাচীন বাংলার কোন ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়নি। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকে বাংলায় গুপ্তদের শাসন-কর্তৃত্ব স্থাপিত ছিল। খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে গুপ্তবংশের অবক্ষয়ের যুগে আর্যাবর্তে জনৈক যশোবর্মনের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। সম্ভবত বাংলাদেশও যশোবর্মনের অধিকারভুক্ত ছিল। অবশ্য তা ছিল সাময়িক। অতঃপর গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য, সমাচারদের নামক তিনজন রাজা বাংলার বিস্তীর্ণ অংশে স্বাধীন রাজত্ব পরিচালনা করেছিল। এই অংশ ‘বঙ্গ’ নামে অভিহিত হত। শশাঙ্ক এই বঙ্গ রাজ্যের ওপর স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। সম্ভবত স্বাধীন গৌড় রাজ্যের উত্থানের ফলে স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছিল।
খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের একাংশ নিয়ে গৌড় রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়। গৌড়ের প্রথম বাঙালী সার্বভৌম রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। শশাঙ্কের নেতৃত্বে গৌড় রাজ্য যথেষ্ট শক্তির অধিকারী হয়েছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড়বঙ্গে দারুণ অরাজকতা দেখা দেয়, যা ইতিহাসে ‘মাৎস্যনায়’ নামে খ্যাতি লাভ করছে। শেষ পর্যন্ত গোপালের নেতৃত্বে পালবংশের শাসন শুরু হলে গৌড়বঙ্গে আবার শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। পালবংশের পরে বাংলাদেশে শুরু হয় সেনবংশের শাসন। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে পাল ও সেন যুগে। অতঃপর মুসলমানদের আক্রমণ ও মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।