মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতা কী অবধারিত ছিল?

মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতা কী অবধারিত ছিল?:  ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত নানান ক্ষোভ ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করে সূচিত ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর সমর্থন, জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মহাবিদ্রোহের এই ব্যর্থতার মূলে একাধিক কারণ ছিল, যথা—

মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতা কী অবধারিত ছিল
মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতা কী অবধারিত ছিল

মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতা কী অবধারিত ছিল

1. পরিকল্পনার অভাব

বিদ্রোহের কোনো সুগঠিত পরিকল্পনা বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা যথাযথ রণকৌশল না-থাকায় প্রথম থেকেই এর সাফল্যলাভের সম্ভাবনা ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ায় বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ প্রশাসনের বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

2. বিদ্রোহের সীমাবদ্ধতা

ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহ প্রসারিত হলেও, তা কিন্তু মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের বিহার, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্রোহের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না।

3. বিভিন্ন জাতি ও দেশীয় রাজাদের বিরোধিতা

ভারতের বিভিন্ন জাতি ও দেশীয় রাজারা বিদ্রোহের বিরোধিতা করে ব্রিটিশদের সমর্থন করেন। হায়দ্রাবাদের নিজাম, কাশ্মীরের মহারাজা, সিন্ধিয়া, পাতিয়ালা ও গুরখা বীর স্যার জঙ্গবাহাদুর প্রভৃতি দেশীয় রাজা ও অসংখ্য ছোটো-বড়ো জমিদার বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন।

4. অযোগ্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব

যে-কোনো বড়ো আন্দোলন বা বিদ্রোহের সাফল্য নির্ভর করে তার সুযোগ্য নেতৃত্বের ওপর; অথচ এই বিদ্রোহের সর্বজনস্বীকৃত নেতা সম্রাট বাহাদুর শাহ ছিলেন বৃদ্ধ, দুর্বল ও অযোগ্য।

5. আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও রণকৌশলের অভাব

অর্থ, রসদ, সমরোপকরণের দিক দিয়েও বিদ্রোহীরা ব্রিটিশদের সমকক্ষ ছিল না। হিউরোজ প্রমুখ ইংরেজ সেনাপতিদের উন্নতমানের রণকৌশলের কাছে বিদ্রোহীরা নাজেহাল হয়ে পড়ে।

6. যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা

রেলওয়ে ও টেলিগ্রাফ এই দুটি বিভাগ ইংরেজ প্রশাসনের অধীনে থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগরক্ষা করে দ্রুত সংবাদ ও সৈন্য ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল, অন্য দিকে ভারতীয়দের এই সুযোগ ছিল না।মহাবিদ্রোহের চিত্র


টীকা লেখো : মহাবিদ্রোহ ও জাতীয়তাবোধ

উত্তর:- ভূমিকা : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময় ভারতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ গড়ে না-উঠলেও সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশ-বিরোধী মানসিকতা তৈরি হয়েছিল, যাকে কার্ল মার্কস ‘অজ্ঞাত ও অবচেতন হাতিয়ার’ (‘unconscious tool of history in learning about the revolution) বলেছেন।

জাতীয়তাবোধের স্বরূপ

1. হিন্দু মুসলিম ঐক্য

মহাবিদ্রোহের একটি বিশেষ দিক ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। বিদ্রোহীদের মধ্যে জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা ছিল না, কিন্তু জাতীয়তাবোধ ছিল। বিদ্রোহীরা ‘গণতন্ত্র’ বা ‘প্রজাতন্ত্র কথাটি চয়ন করতে না পারলেও তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ বিতাড়ন।

2. প্রধান নেতা নির্বাচন

বিদ্রোহীরা ভারতের শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে বিদ্রোহের প্রধান নেতার পদে মনোনীত করে ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন।

অখণ্ড ভারত আদর্শ

বিদ্রোহকাল হিন্দু ও মুসলিম সিপাহিরা এক অখণ্ড ভারতের ধারণা তুলে ধরে নিজেদেরকে হিন্দুস্তানের বাসিন্দা বলে ঘোষণা করেছিল। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মনে করেন ভারতের জাতীয়তাবোধ উন্মেষে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থান কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। অধ্যাপক রজতকান্ত রায় এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেছেন।

জাতীয় আন্দোলনের অনুপ্রেরণা

১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে ভারতের মুক্তিসংগ্রামে এই মহাবিদ্রোহের স্মৃতি অনুপ্রেরণা জোগায়। নানা সাহেব, লক্ষ্মীবাই জাতীয় বীরের আসনে প্রতিষ্ঠিত হন। মূল্যায়ন : মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনের বৈষম্যমূলক দিকগুলি সম্পর্কে সচেতন হয়ে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হলে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে।


বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা স্থাপনের উদ্দেশ্য কী ছিল? অথবা, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সমিতি কতদূর সফল হয়েছিল?

(উত্তর) উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের আগেই হিন্দু কলেজ ও অন্য ইংরেজি বিদ্যালয়গুলিতে কিশোর ও যুবক ছাত্ররা সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার জন্য বিতর্কসভা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এই বিতর্কসভাগুলিতে আলোচনার মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদ্বজ্জনদের একটি সভায় এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, এবার থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনাগুলি বাংলা ভাষাতেই করা হবে। এই সভাটির নাম ছিল ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা’। এর বছর তিনেকের মধ্যে এই সভাটিই সম্প্রসারিত হয়ে স্থাপিত হল ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ (১৮৩৬)। সেই সময়ে নিষ্কর জমির বাজেয়াপ্তকরণ নিয়ে জনমত উত্তাল হয়ে উঠেছিল। অতএব বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা এই বিষয়টি নিয়েই আন্দোলন শুরু করলেন। এই উদ্দেশ্যে খানিকটা সফল হলেও এই সভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এই সভাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক সভা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *