শশাঙ্কের নেতৃত্বে গৌড়ের উত্থানের কাহিনী বর্ণনা কর। রোটাসগড় লিপিতে শশাঙ্ককে কি নামে অভিহিত করা হয়েছে? বাণভট্ট বিদ্বেষবশত শশাঙ্ককে কোন দুই নামে অভিহিত করেছেন?

উত্তর। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পরে গুপ্ত-নামধারী রাজাগণ গৌড়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে গৌড় জনপদ গঠিত ছিল। গুপ্তরাজ বৈন্যগুপ্তের মৃত্যুর পর থেকে কনৌজের মৌখরী রাজগণের সাথে পরবর্তী গুপ্তদের নিরন্তর যুদ্ধ চলে। সেই সঙ্গে চালুক্যবংশীয় রাজারাও বার বার গুপ্তদের আক্রমণ করতে থাকেন। ফলে গুপ্তগণ ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়েন। সেই সুযোগে মহাসেনগুপ্তের জনৈক সামন্তরাজা শশাঙ্ক গৌড় দখল করে এক স্বাধীন গৌড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। (৬০০ খ্রীঃ)।

উপাদান

শশাঙ্কের রাজত্বকাল সম্বন্ধে জানার জন্য আমাদের মূলত বাণভট্টের হর্ষচরিত’ ও হিউয়েন সাং-এর ‘বিবরণের’ ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বাণভট্ট ছিলেন শশাঙ্কের বিরোধী এবং হিউয়েন সাং ছিলেন হর্ষের সাহায্যপ্রাপ্ত। এই কারণে দু’জনেরই পক্ষপাতমূলক বিবৃতি দিয়েছেন বলে অনুমিত হয়।

বংশপরিচয়

‘নরেন্দ্রগুপ্ত’ বা ‘নরেন্দ্রদিত্য’ নাম পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে অনেকে মনে করেন, তিনি গুপ্তবংশীয় শাসক ছিলেন। কারও কারও মতে, তিনি ছিলেন গৌড়ের পূর্ববর্তী রাজা জয়নাগের বংশধর। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, শশাঙ্ক ছিলেন পরবর্তী গুপ্তরাজা মহাসেনগুপ্তের সামন্ত এবং গুপ্তবংশের দুর্বলতার সুযোগে গৌড়ে স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজ্যবিস্তার

ড. মজুমদারের মতে, “শশাঙ্কই প্রথম বাঙালী রাজা যিনি আর্যাবর্তে সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।” সামান্য সামন্ত থেকে নিজ বাহুবলে তিনি বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের ‘কর্ণসুবর্ণ’। সিংহাসনে বসেই তিনি রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী হন। প্রথমে তিনি ‘দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর), ‘উৎকল’ (উড়িষ্যা) ও ‘গঞ্জাম’ জেলা জয় করে মহেন্দ্রপর্বত রাজ্যবিস্তার করেন। পশ্চিমে মগধ ও স্বাধীন বঙ্গরাজ্যও নাকি তিনি জয় করেছিলেন।

প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিজোট

পূর্ব-ভারত বিজয়ের পর তিনি পশ্চিম ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন। পশ্চিমে কনৌজ রাজ্যের মৌখরীরা ছিল গৌড়ের শত্রু। থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজশ্রীর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিজোট সঙ্গে কনৌজের মৌখরীরাজ গ্রহবর্মনের বিবাহ হওয়ার ফলে উভয় দেশের মধ্যে মৈত্রী-জোট গড়ে ওঠে। এই অবস্থায় শশাঙ্ক থানেশ্বরের শত্রু মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে পাল্টা মৈত্রী-জোট গঠন করেন।

কনৌজ আক্রমণ

এইভাবে শক্তি-জোট গঠনের পর শশাঙ্ক ও দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করে গ্রহবর্মনকে হত্যা করেন ও রাজশ্রীকে বন্দী করেন। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র থানেশ্বররাজ রাজ্যবর্ধন মালব আক্রমণ করে দেবগুপ্তকে হত্যা করেন। ইতিমধ্যে শশাঙ্ক মালবে উপস্থিত হয়ে রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেন।

শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে কিভাবে হত্যা করেছিলেন সে বিষয়ে মতভেদ আছে। হর্ষচরিতের মতে, শশাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন। হর্ষের ‘লিপি’ থেকে জানা যায়, সত্যরক্ষার্থে শত্রুশিবিরে উপস্থিত হলে গুপ্তঘাতক কর্তৃক নিহত হন। ড. মজুমদারের মতে, শশাঙ্ক ন্যায়যুদ্ধেই রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেন।

শশাঙ্ক-হর্ষ

রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন থানেশ্বর ও কনৌজের রাজা হন। তিনি ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ইতিমধ্যে শশাঙ্কের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে কামরূপরাজ ভাস্করবর্ধন হর্ষের সাথে যোগ দেন। হর্ষের সাথে শশাঙ্কের যুদ্ধ আদৌ হয়েছিল কিনা বা হলেও কি ফল হয়েছিল, তা কোন গ্রন্থেই স্পষ্ট লেখা নেই। আধুনিক পণ্ডিতদের অনুমান, শশাঙ্ক জীবিত থাকা পর্যন্ত হর্ষ তাঁর রাজ্য দখল করতে পারেননি। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর (৬৩৭ খ্রীঃ) তাঁর পুত্র মানবদেবকে পরাজিত করে হর্ষ ও ভাস্করবর্মন বাংলাদেশ ভাগ করে নেন।

কৃতিত্ব

শশাঙ্ক কেবল শক্তিশালী বাংলাই গঠন করেননি। উত্তর-ভারতীয় রাজনীতিতে তাকে মর্যাদার আসনেও প্রতিষ্ঠিত করেন। শশাঙ্কের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তী কালে পালরাজারা বাংলাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যগঠনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাই ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন : “He (Sasanka) laid the foundation of the imperial fabrick in the shape of realised hopes and ideals on which the Pales built at a later age.” শশাঙ্কের সময়েই বাংলার প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য স্বীকৃতি লাভ করে।

ধর্ম

শশাঙ্ক ছিলেন শিবের উপাসক। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব-প্রতিপত্তিও তখন অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু এ তথ্য ঠিক নয়। কারণ হিউয়েন সাং-ই তৎকালীন গৌড়ে বহু বৌদ্ধমঠ ও বৌদ্ধাশ্রমকে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করতে দেখেছিলেন। এইভাবে শশাঙ্ক বাংলাদেশে এক সার্বভৌম রাজ্য ও সুশাসন প্রবর্তন করে স্মরণীয়

হয়ে আছেন। রোটাসগড় লেখতে শশাঙ্ককে ‘শ্রীমহাসামন্ত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বাণভট্ট বিদ্বেষবশত শশাঙ্ককে তার হর্ষচরিত গ্রন্থে গৌড়া-ধর্ম ও গৌড়ভুজঙ্গ নামে অভিহিত করেছেন।

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *