হরপ্পা সভ্যতা কে আবিষ্কার করেন?: হরপ্পা কোন নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল ও প্রাচীনত্ব নিরূপণ কর।

উত্তর। হরপ্পা নগরের আবিষ্কর্তা দয়ারাম সাহানী (১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ)। হরপ্পা রাভি নদীর তীরে অবস্থিত ছিল।

বহুকাল ধরে আমাদের ধারণা ছিল, আর্য-সভ্যতাই ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা। কিন্তু ১৯২১-২২ খ্রীষ্টাব্দে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহানী যথাক্রমে সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো এবং পাঞ্জাবের মন্টগোমারী জেলার ‘হরপ্পা’ নামক স্থান দুটিতে খননকার্য চালিয়ে এক সুপ্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাগ্-বৈদিক যুগে ভারতে এক উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।

পরবর্তীকালে স্যার জন মার্শাল ও মাটিমার হুইলারের তত্ত্বাবধানে আরও খননকার্য চালিয়ে এই সভ্যতার বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐতিহাসিক উইলি ডুরান্ট (W. Dwrant) সিন্ধু সভ্যতাকে মিশরীয় সভ্যতার থেকেও প্রাচীনতম বলে মনে করেন। তাঁর ভাষায় : “The Indus valley civilization was older than that which flowered out of the mud of the Nile.” স্যার লিওনাভ গুলি (L. Wooley) ও সিন্ধু-সভ্যতার ঐতিহ্যবিহীন প্রাচীনত্বের কথা কল্পনা করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। উপযুক্ত তথ্যের অভাবহেতু সিন্ধু-সভ্যতার কালনির্ণয় কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

হরপ্পা সভ্যতা: পূর্ব যুগ

খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনাদির বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতগণ এই সভ্যতার সময়কাল নির্ণয়ে সচেষ্ট হয়েছেন। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত নিদর্শনাদির ভিত্তিতে মনে করা হয় যে, সিন্ধু অঞ্চলের অধিবাসীরা লোহার ব্যবহার জানত না। তাহলে ধরা যেতে পারে, প্রাচীন প্রস্তরযুগ, নব্য প্রস্তরযুগের ও লৌহযুগের মধ্যবর্তী সময়ে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। পণ্ডিতদের অনুমান খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দেরও আগে লৌহযুগের শুরু হয়েছে। এই তারিখটিকে সিন্ধু সভ্যতার নিম্নতম কালসীমা ধরা যেতে পারে। অতএব ধরা যেতে পারে, ৩০০০ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে সিন্ধু-সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।

সুমেরীয়-সভ্যতার সঙ্গে মিল

সিন্ধু-সভ্যতার সীলমোহরের অনুরূপ কিছু সীলমোহর মেসোপটেমিয়া, এলাম, ব্যাবিলন প্রভৃতি স্থানে পাওয়া গেছে। এগুলির আকৃতিগত সাদৃশ্য বিচার করে ড. গ্যাড্ সিন্ধু-সভ্যতার সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। জন মার্শালের মতে, এই সভ্যতার সময়কাল ছিল ৩২৫০ এবং ২৭৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী কোন সময়। তেল-আসরামে প্রাপ্ত সিন্ধু-সভ্যতার সীলের ভিত্তিতে ড. ফ্রাঙ্কফুট ২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দকে এই সভ্যতার বিকাশকাল বলে নির্দেশ করেছেন। এখন যদি ধরা যায়, সিন্ধু-সভ্যতা অন্ততঃ ৫০০ বছর ভ্রূণ অবস্থায়

ছিল, তাহলে ২৮০০ + ৫০০ = ৩৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এই সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। মার্টিমার হুইলার হরপ্পা-সংস্কৃতির সময়কাল হিসেবে ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দকে গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এই হাজার বছরের সময়সীমা অনেকে অবাস্তব বলে মনে করেন।

কার্বন-১৪ পদ্ধতি

রেডিও-কার্বন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তারিখগুলি সিন্ধু-সভ্যতার সময়কাল নির্ধারণে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ্ ফাণ্ডামেন্টাল’ রিসার্চের ড. অগ্রবাল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পরীক্ষার পর বলেছেন, “সিন্ধু-সভ্যতার কালানুক্রম চতুর্বিংশ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই।”

মেসোপটেমিয়ার প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে মি. বুকানন মন্তব্য করেছেন, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা-সংস্কৃতির পরিণত পর্যায়ের জন্য খ্রীষ্টপূর্ব ত্ৰি-বিংশ শতাব্দী অতিক্রম করে পিছিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তাঁর মতে, সভ্যতার এই পরিণত পর্ব তিনশত বছরের অধিক স্থায়ী ছিল না। সুতরাং এ কথা বিশ্বাস করা যায় যে, এই সভ্যতার পরিণত পর্ব ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে শেষ হয়েছিল। হরপ্পা এবং ‘চান্-হ-দরো’তে প্রাপ্ত ‘বিস্তৃতপক্ষ ঈগল’ সীলের সঙ্গে ২৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ‘সিউসায়’ প্রাপ্ত সীলের সামঞ্জস্য এই মতকে সমর্থন করে।

মোটামুটিভাবে বলা যায়, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সিন্ধু-সভ্যতার সীলের অনুরূপ যে সীল পাওয়া গেছে, তাদের অধিকাংশই ইসিন যুগ ও লারসা যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাহলে ধরা যেতে পারে, খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের মধ্যে সিন্ধু-মেসোপটেমিয়া সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল।

হরপ্পা-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র কালিবনগান, লোথান, রোজদি প্রভৃতি স্থানের প্রাথমিক স্তরগুলির ‘কার্বন-১৪’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নির্ণয় করা হয়েছে তা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাবিংশ শতাব্দী এবং সর্বশেষ স্তরগুলি খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীর পুরানো। এই রেডিও-কার্বন পদ্ধতি সর্বাধিক বিশ্বাসযোগ্য ; কারণ এটি অনুমানভিত্তিক নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *